
কোরবানি কাদের ওপর ফরজ: শরিয়তের বিধান ও শর্তসমূহ
কোরবানি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখে পালিত হয়। এটি হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর ত্যাগ ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের স্মরণে পশু জবাইয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। কোরবানি শব্দের অর্থ "নৈকট্য অর্জন", যা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের একটি মাধ্যম। তবে কোরবানি সবার জন্য ফরজ বা ওয়াজিব নয়; এর জন্য নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করতে হয়। এই আর্টিকেলে আমরা কোরবানি কাদের ওপর ফরজ বা ওয়াজিব, এর শর্ত, নিসাবের হিসাব, এবং সংশ্লিষ্ট বিধান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
কোরবানি কী এবং এর তাৎপর্য
কোরবানি হলো আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে শরিয়তসম্মত পশু জবাই করা। কুরআনে এর উল্লেখ রয়েছে সূরা কাউসারে (১০৮:২):
"তোমার প্রভুর জন্য নামাজ পড়ো এবং কোরবানি করো।"
হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
"যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।" (ইবনে মাজাহ)
কোরবানি ত্যাগের চেতনাকে জাগ্রত করে এবং সমাজে দরিদ্রদের মাঝে গোশত বিতরণের মাধ্যমে সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি করে। তবে এই ইবাদত কেবলমাত্র নির্দিষ্ট শর্ত পূরণকারীদের জন্য ওয়াজিব।
কোরবানি ফরজ নাকি ওয়াজিব?
ইসলামী আলেমদের মধ্যে কোরবানির হুকুম নিয়ে মতভেদ রয়েছে।
- হানাফি মাযহাব: কোরবানি সাহেবে নিসাব ব্যক্তির জন্য ওয়াজিব। এটি ফরজের তুলনায় কিছুটা কম বাধ্যতামূলক, তবে ত্যাগ করা গুনাহের কারণ হতে পারে।
- শাফিঈ, মালেকি ও হাম্বলি মাযহাব: কোরবানি সুন্নতে মুয়াক্কাদা (জোরালোভাবে পালনীয় সুন্নত), তবে সামর্থ্য থাকলে তা পরিত্যাগ করা মাকরুহ।
এই আর্টিকেলে আমরা হানাফি মাযহাবের দৃষ্টিকোণ থেকে কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার শর্ত আলোচনা করব, যা বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ মুসলিম অনুসরণ করে।
কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার শর্ত
কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য নিম্নলিখিত শর্ত পূরণ করতে হয়:
-
মুসলিম হওয়া:
- কোরবানি কেবল মুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য। অমুসলিমদের উপর এই ইবাদত বাধ্যতামূলক নয়।
-
প্রাপ্তবয়স্ক ও বিবেকবান হওয়া:
- ব্যক্তিকে প্রাপ্তবয়স্ক (বালেগ) এবং মানসিকভাবে সুস্থ হতে হবে। অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু বা মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির উপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। তবে অভিভাবক তাদের সম্পদ থেকে কোরবানি করতে পারেন।
-
সাহেবে নিসাব হওয়া:
- ব্যক্তির কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে। নিসাব হলো সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ (৮৭.৪৮ গ্রাম) বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রৌপ্য (৬১২.৩৬ গ্রাম) বা এর সমপরিমাণ অর্থ বা সম্পদ।
- এই সম্পদ মৌলিক চাহিদা (যেমন, বাসস্থান, খাদ্য, পোশাক, গৃহস্থালি সামগ্রী) পূরণের পর অতিরিক্ত হতে হবে।
-
অধিবাসী হওয়া:
- কোরবানি শুধুমাত্র অধিবাসী (মুকিম) ব্যক্তির উপর ওয়াজিব। মুসাফির (যিনি শরিয়ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট দূরত্বের ভ্রমণে আছেন) এর উপর কোরবানি ওয়াজিব নয়, তবে তারা ইচ্ছা করলে কোরবানি করতে পারেন।
-
সময়ের মধ্যে সম্পদ থাকা:
- কোরবানির জন্য সম্পদ এক বছর ধরে থাকার শর্ত নেই, যেমন জাকাতের ক্ষেত্রে। জিলহজ মাসের ১০ তারিখ ফজর থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের মধ্যে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলেই কোরবানি ওয়াজিব হয়।
নিসাবের হিসাব কীভাবে করবেন?
নিসাব নির্ধারণের জন্য নিম্নলিখিত সম্পদ গণনা করা হয়:
- নগদ অর্থ: ব্যাংক বা হাতে থাকা নগদ টাকা।
- স্বর্ণ ও রৌপ্য: গহনা, মুদ্রা বা অন্যান্য আকারে স্বর্ণ-রৌপ্য।
- ব্যবসায়িক সম্পদ: বিক্রয়যোগ্য পণ্য বা শেয়ার।
- অন্যান্য সম্পদ: যেমন, বিনিয়োগ বা সঞ্চয়, যা মৌলিক চাহিদার বাইরে।
গণনার পদ্ধতি:
- মোট সম্পদ থেকে ঋণ (যদি থাকে) বিয়োগ করুন।
- মৌলিক চাহিদার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ (যেমন, বাসস্থান, গাড়ি, গৃহস্থালি সামগ্রী) বাদ দিন।
- অবশিষ্ট সম্পদ যদি সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রৌপ্যের সমপরিমাণ হয়, তবে আপনি সাহেবে নিসাব।
উদাহরণ:
- ধরুন, আপনার কাছে ৫০,০০০ টাকা নগদ, ১০ গ্রাম স্বর্ণ (মূল্য ৮০,০০০ টাকা), এবং ব্যবসায়িক সম্পদ ১,০০,০০০ টাকা আছে। মোট সম্পদ = ২,৩০,০০০ টাকা।
- আপনার ঋণ ৫০,০০০ টাকা। তাই অবশিষ্ট সম্পদ = ১,৮০,০০০ টাকা।
- এই পরিমাণ যদি রৌপ্যের নিসাব (ধরুন, ১,৫০,০০০ টাকা) এর বেশি হয়, তবে কোরবানি ওয়াজিব।
কাদের উপর কোরবানি ওয়াজিব নয়?
নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের উপর কোরবানি ওয়াজিব নয়:
- অমুসলিম।
- অপ্রাপ্তবয়স্ক বা মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি।
- যাদের নিসাব পরিমাণ সম্পদ নেই।
- মুসাফির (শরিয়ত অনুযায়ী ভ্রমণকারী)।
- যারা ঋণগ্রস্ত এবং ঋণ পরিশোধের পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ অবশিষ্ট থাকে না।
কোরবানির জন্য পরিবারের বিধান
- প্রত্যেক সাহেবে নিসাব ব্যক্তি: পরিবারের প্রত্যেক সদস্য (যেমন, স্বামী, স্ত্রী, প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান) যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তবে তাদের প্রত্যেকের জন্য কোরবানি ওয়াজিব।
- একটি কোরবানি: হানাফি মাযহাবে একটি ছাগল বা গরুর একটি অংশ একজন ব্যক্তি বা তার পরিবারের জন্য যথেষ্ট। তবে স্ত্রী বা সন্তানের পৃথক সম্পদ থাকলে তাদের জন্য পৃথক কোরবানি করা উত্তম।
- শিশুদের জন্য: অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের সম্পদ থেকে অভিভাবক কোরবানি করতে পারেন, তবে এটি বাধ্যতামূলক নয়।
কোরবানির সময় ও নিসাব
কোরবানি জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে করা হয়। নিসাব পরিমাণ সম্পদ এই সময়ের মধ্যে থাকলেই কোরবানি ওয়াজিব। যদি কেউ ১০ তারিখে সাহেবে নিসাব হয়, কিন্তু ১১ তারিখে সম্পদ হারায়, তবুও তার উপর কোরবানি ওয়াজিব থাকবে।
কোরবানির গুরুত্ব ও উপকারিতা
- আধ্যাত্মিক তাৎপর্য: কোরবানি আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম এবং ত্যাগের চেতনাকে জাগ্রত করে।
- সামাজিক উপকারিতা: গোশত বিতরণের মাধ্যমে দরিদ্রদের সাহায্য করা হয়, যা সমাজে সংহতি বাড়ায়।
- ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা: সাহেবে নিসাব ব্যক্তির জন্য কোরবানি পালন গুনাহ থেকে মুক্তি দেয়।
সতর্কতা
- ভুল হিসাব: সম্পদের হিসাবে ভুল করলে কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার বিষয়টি ভুল বোঝা যেতে পারে। সঠিক হিসাবের জন্য আলেমের পরামর্শ নিন।
- অজ্ঞতা: অনেকে মনে করেন কোরবানি সবার জন্য বাধ্যতামূলক। শর্ত না জানার কারণে অপ্রয়োজনীয় চাপ অনুভব করা যেতে পারে।
- অপচয়: সামর্থ্য না থাকলে ঋণ করে কোরবানি করা শরিয়তের দৃষ্টিকোণে উচিত নয়।
কোরবানি একটি পবিত্র ইবাদত, যা সাহেবে নিসাব মুসলিমদের জন্য ওয়াজিব। মুসলিম, প্রাপ্তবয়স্ক, বিবেকবান, অধিবাসী এবং নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া এর প্রধান শর্ত। সঠিকভাবে নিসাবের হিসাব করে এবং শরিয়তের বিধান মেনে কোরবানি পালন করলে একজন মুমিন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেন। তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত কোরবানির শর্ত সম্পর্কে জানা এবং নিজের অবস্থান পরীক্ষা করে এই ইবাদত পালন করা। এটি কেবল ধর্মীয় দায়িত্বই নয়, বরং সমাজে ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠার একটি মাধ্যম।