তায়াম্মুম কখন করবেন এবং সঠিক নিয়ম
religious

তায়াম্মুম কখন করবেন এবং সঠিক নিয়ম

about 2 hours ago
9
0

ইসলাম এমন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা যেখানে মানুষের যেকোনো পরিস্থিতিকেই বিবেচনায় নিয়ে সহজতার পথ রাখা হয়েছে। নামাজ (salat) মুসলিম জীবনের কেন্দ্রবিন্দু, আর নামাজ শুদ্ধভাবে আদায়ের জন্য ওযু (wudu) বা গোসল অপরিহার্য। তবে কিছু পরিস্থিতিতে পানি ব্যবহার করা অসম্ভব হয়ে গেলে ইসলাম বিকল্প পথ হিসেবে দিয়েছে tayammum—একটি সহজ, পবিত্রতা অর্জনের বিশেষ পদ্ধতি। এই প্রবন্ধে আমরা বিশদভাবে দেখব tayammum কী, এর ইতিহাস, কোন অবস্থায় এটি বৈধ, কোন উপাদান দিয়ে করা হয় এবং সহিহ হাদিস অনুযায়ী এর ধাপসমূহ।


তায়াম্মুম কী? (Definition of Tayammum)

আরবি শব্দ tayammum এর অর্থ হলো “উদ্দেশ্য করা” বা “মুখ করা”—অর্থাৎ নির্দিষ্টভাবে মাটির দিকে মনোযোগ দিয়ে পবিত্রতা অর্জনের চেষ্টা। শরিয়তের পরিভাষায়, পানি ব্যবহার করতে অক্ষম হলে পরিষ্কার মাটি বা মৃত্তিকা জাতীয় কিছু ব্যবহার করে যে বিকল্প পবিত্রতা অর্জন করা হয়, তাকে তায়াম্মুম বলা হয়।

রেফারেন্স

📌 কুরআন:

“...আর পানি না পেলে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করো।” — সুরা মা’ইদাহ ৫:৬

📌 হাদিস: রাসূল ﷺ বলেন:

“পুরো পৃথিবীকে আমার জন্য পবিত্র এবং মসজিদ করা হয়েছে।” — সহিহ বুখারি (৩৩৫)


তায়াম্মুমের ইতিহাস

তায়াম্মুমের বিধান নাযিল হয় একটি বিশেষ ঘটনার পর। আয়েশা (রাঃ) এর হারানো হার খুঁজতে গিয়ে পুরো কাফেলা থেমে যায় এবং আশেপাশে পানি না থাকায় সাহাবিরা বিপাকে পড়েন। তখন কুরআনের আয়াত নাযিল হয় যেখানে তায়াম্মুমের অনুমতি দেওয়া হয়।

এই ঘটনা প্রমাণ করে যে ইসলাম কষ্টকে সরিয়ে সহজতার পথ বেছে নেয়—যা একে বৈশ্বিক ও মানবিক ধর্ম হিসেবে আলাদা করে।

রেফারেন্স

— সহিহ বুখারি (৩৩৪)


তায়াম্মুম কখন করা বৈধ?

এখানেই ভুল সবচেয়ে বেশি হয়। অনেকেই মনে করেন সামান্য অসুবিধা হলেই তায়াম্মুম করা যায়, যা সঠিক নয়। শরিয়ত তায়াম্মুমকে অনুমতি দিয়েছে কেবল যখন পানি ব্যবহার করা সম্ভব নয় বা ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। চলুন যুক্তিসঙ্গতভাবে বিশ্লেষণ করা যাক—

১. পানি না পাওয়া

এটি সবচেয়ে সরল এবং প্রধান কারণ। যদি পানি অনুসন্ধানের পরও না পাওয়া যায়, তাহলে তায়াম্মুম বৈধ।

রেফারেন্স: সুরা মা’ইদাহ ৫:৬


২. পানি থাকলেও ব্যবহার করলে শারীরিক ক্ষতির আশঙ্কা

যেমন—

  • প্রচণ্ড ঠান্ডায় পানি ব্যবহার করলে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি
  • ক্ষত, ফ্র্যাকচার বা পোস্ট-সার্জারি অবস্থা
  • চিকিৎসকের নিষেধ “পানির সংস্পর্শ বিপজ্জনক”

রেফারেন্স: রাসূল ﷺ আহত এক সাহাবির পানির বদলে তায়াম্মুম করতে বলেছিলেন। — সুনান আবু দাউদ (৩৩৬)


৩. পানি অত্যন্ত কম, যা দিয়ে জীবনরক্ষা জরুরি

যেমন—

  • পথ চলায় সামান্য পানি আছে, যা পান না করলে ডিহাইড্রেশন বা মৃত্যুঝুঁকি
  • সঙ্গে থাকা পানি অসুস্থ পরিবারের সদস্য বা শিশুর প্রয়োজনে প্রয়োজন

৪. পানি দূরে, আনতে গেলে সময় শেষ হয়ে যাবে

যদি পানি পাওয়ার চেষ্টা করলে নামাজের সময় বের হয়ে যায়, তবে তায়াম্মুম বৈধ। ইসলামের মূলনীতি—নামাজের সময় নষ্ট নয়।


৫. পানি সংগ্রহ করলে নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকে

যেমন—

  • বিপদজনক বন্যপ্রাণী
  • ডাকাতির সম্ভাবনা
  • যুদ্ধ পরিস্থিতি

ইসলাম সর্বদা নিজের জীবন রক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়।


তায়াম্মুমের জন্য কোন কোন জিনিস ব্যবহার করা যায়?

অনেক ভুল শিক্ষায় মানুষ বিভ্রান্ত হয়—তাই বিষয়টি স্পষ্ট করা প্রয়োজন।

ইসলামের ফিকহ অনুযায়ী, tayammum এর জন্য মূল শর্ত হলো: পবিত্র মাটির উপাদান হতে হবে, যাতে প্রাকৃতিক ধুলা থাকে।

যা দিয়ে তায়াম্মুম করা বৈধ:

  • শুকনো মাটি
  • বালি
  • পাথর
  • মাটির দেয়াল
  • ধুলাযুক্ত ইট বা কাদা
  • যেকোনো প্রাকৃতিক মৃত্তিকা

যা দিয়ে তায়াম্মুম বৈধ নয়:

  • কাদামাটি যা ভেজা
  • কাঠ/লোহা/প্লাস্টিক, যেখানে ধুলা নেই
  • রঙ করা দেয়াল
  • কাপড় বা কাগজ

ফিকহ ভিত্তিক যুক্তি

সাহাবিরা পাথর, বালি, ধুলা—বহু উপাদান দিয়ে তায়াম্মুম করেছেন। (রেফারেন্স: ইবনু তাইমিয়্যাহ, মজমু’ ফাতাওয়া)


তায়াম্মুমের সঠিক নিয়ম

এখন আসল অংশ—প্রক্রিয়াটি কীভাবে করতে হয়। সঠিক পদ্ধতি জানলে ভুলের সুযোগ থাকে না।

ধাপ-১: নিয়ত

“পবিত্রতা অর্জন করে নামাজ পড়ব”—মনে মনে এই নিয়ত করা।


ধাপ-২: পবিত্র মাটিতে দুই হাত রেখে ধুলা নেওয়া

মাটি, বালি বা ধুলার উপর হাত রাখা। হালকা ধুলা লাগলেই যথেষ্ট।


ধাপ-৩: পুরো মুখ মাসাহ করা

হাতে থাকা ধুলা দিয়ে সম্পূর্ণ মুখে মাসাহ করবেন।


ধাপ-৪: আবার হাত মাটিতে রেখে দুই হাত কনুই পর্যন্ত মাসাহ করা

এবার কনুই পর্যন্ত হাত মাসাহ করতে হবে। কোনো অংশ বাদ দেওয়া যাবে না।


রেফারেন্স (সহিহ হাদিস):

রাসূল ﷺ বলেন: “তোমাদের জন্য যথেষ্ট হলো এইভাবে—একবার হাত মাটিতে রেখে মুখ ও হাত মুছা।” — সহিহ মুসলিম (৩৬৮)


তায়াম্মুমে যেসব ভুল সাধারণত দেখা যায়

এই অংশটি অপরিহার্য, কারণ ভুলের কারণে অনেকের তায়াম্মুম শুদ্ধ হয় না।

১. শুধু মুখ মুছে শেষ করা

এটি ভুল—হাত কনুই পর্যন্ত মাসাহ করতে হয়।

২. ধুলাবিহীন বস্তু দিয়ে তায়াম্মুম করা

ডিজিটাল টেবিল, প্লাস্টিক, কাঁচ—এসব বৈধ নয়।

৩. পানি থাকা অবস্থায় অলসতা করে তায়াম্মুম করা

ইসলাম অলসতাকে অনুমোদন করে না।

৪. একই তায়াম্মুম দিয়ে বহু নামাজ পড়া

এক তায়াম্মুমে এক ফরজ নামাজ—এটাই অধিক গ্রহণযোগ্য মত।


তায়াম্মুম ভেঙে যায় কোন কোন কারণে?

যে কারণে ওযু ভেঙে যায়, একই কারণে তায়াম্মুমও ভেঙে যায়। অর্থাৎ—

  • পাদ
  • ঘুম
  • নাপাকির নির্গমন
  • অজ্ঞান হওয়া

এছাড়া, পানি পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিকভাবে তায়াম্মুম বাতিল হয়ে যায়।


তাহলে তায়াম্মুম—কেবল জরুরি অবস্থার সমাধান?

হ্যাঁ। ইসলাম সহজতার ধর্ম হলেও, পানি থাকলে tayammum কখনোই ওযুর বিকল্প নয়। শরিয়তের উদ্দেশ্য হলো মানুষের কষ্ট কমানো—কিন্তু নিয়ম ভেঙে সহজতা খোঁজা নয়।


salat ও পবিত্রতার সম্পর্ক

নামাজ আল্লাহর কাছে পৌঁছাতে হলে পবিত্রতা অপরিহার্য। এই কারণেই ইসলাম wudu কে ফরজ করেছে। কিন্তু যখন পানি নেই বা ব্যবহার অসম্ভব, তখন tayammum একই পবিত্রতার মর্যাদা বহন করে। এটি ইসলামের নমনীয়তা ও বাস্তববাদের অসাধারণ উদাহরণ।


tehmoom বা তায়াম্মুম—শব্দ বিভ্রান্তি

অনেক সময় মানুষ tehmoom লিখে থাকে, যা ভুল বানান। Arabically সঠিক শব্দ হলো tayammum