
কোরবানির নিয়ম-কানুন: শরিয়তসম্মত পদ্ধতিতে ত্যাগের ইবাদত সম্পন্ন করুন
কোরবানি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখে পালিত হয়। এটি হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর ত্যাগ ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের স্মরণে পশু জবাইয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। কোরবানি শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং আল্লাহর নৈকট্য অর্জন এবং সমাজে দরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের একটি মাধ্যম। তবে কোরবানি সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে শরিয়তের নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন মেনে চলা অপরিহার্য। এই আর্টিকেলে আমরা কোরবানির নিয়ম-কানুন, পশু নির্বাচন, জবাইয়ের পদ্ধতি, গোশত বণ্টন, এবং সতর্কতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
কোরবানির তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য
কোরবানি শব্দের অর্থ "নৈকট্য অর্জন"। কুরআনে এর নির্দেশ রয়েছে সূরা কাউসারে (১০৮:২):
"তোমার প্রভুর জন্য নামাজ পড়ো এবং কোরবানি করো।"
হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
"কোরবানির দিনে কোরবানির চেয়ে প্রিয় কোনো কাজ আল্লাহর কাছে নেই।" (তিরমিজি)
কোরবানি ত্যাগের চেতনাকে জাগ্রত করে, সম্পদের প্রতি লোভ কমায় এবং সমাজে গোশত বিতরণের মাধ্যমে দরিদ্রদের সাহায্য করে। তবে এই ইবাদত শরিয়তসম্মতভাবে সম্পন্ন করা জরুরি।
কোরবানির সময় ও স্থান
- সময়: কোরবানি জিলহজ মাসের ১০, ১১ এবং ১২ তারিখে সূর্যাস্তের আগে করতে হয়। ১০ তারিখ ঈদের নামাজের পর কোরবানি শুরু করা উত্তম। শহরাঞ্চলে ঈদের নামাজের পর এবং গ্রামাঞ্চলে ফজরের পর থেকে কোরবানি শুরু করা যায়।
- স্থান: নিজ এলাকায় কোরবানি করা মুস্তাহাব। তবে দরিদ্র অঞ্চলে বা অন্য দেশে কোরবানি পাঠানো জায়েজ। কোরবানি পরিষ্কার, উন্মুক্ত স্থানে করা উচিত।
কোরবানির পশু নির্বাচন
কোরবানির জন্য পশু নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত শর্ত মেনে চলতে হয়:
-
পশুর ধরন:
- কোরবানির জন্য ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, গরু, মহিষ, উট বা দুগ্ধবতী উট জবাই করা যায়।
- ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা একজন ব্যক্তির জন্য, আর গরু, মহিষ বা উটে সর্বোচ্চ সাতজন শরিক হতে পারেন।
-
বয়স:
- ছাগল, ভেড়া, দুম্বা: ন্যূনতম ১ বছর।
- গরু, মহিষ: ন্যূনতম ২ বছর।
- উট: ন্যূনতম ৫ বছর।
- তবে ভেড়া বা দুম্বা যদি ৬ মাসের হয় এবং আকারে এক বছরের মতো দেখায়, তবে তা গ্রহণযোগ্য।
-
স্বাস্থ্য ও শারীরিক অবস্থা:
- পশু সুস্থ, নির্দোষ এবং শরিয়তসম্মত হতে হবে।
- অন্ধ, খোঁড়া, অতিরিক্ত দুর্বল, কান বা শিং সম্পূর্ণ ভাঙা, দাঁতবিহীন বা অসুস্থ পশু কোরবানির জন্য গ্রহণযোগ্য নয়।
- সামান্য ত্রুটি (যেমন, শিংয়ের সামান্য ভাঙা) কোরবানির জন্য বাধা নয়।
-
মালিকানা:
- পশু কেনার সময় পূর্ণ মালিকানা নিশ্চিত করতে হবে। ধার বা ঋণের পশু কোরবানির জন্য জায়েজ নয়।
কোরবানির প্রস্তুতি
কোরবানির আগে নিম্নলিখিত প্রস্তুতি গ্রহণ করা সুন্নাত ও শরিয়তের নির্দেশ:
-
নিয়ত:
- কোরবানি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করতে হবে। নিয়ত মনে মনে করা যথেষ্ট, উচ্চারণের প্রয়োজন নেই।
- উদাহরণ: "আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করছি।"
-
চুল-নখ না কাটা:
- জিলহজ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কোরবানি সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত চুল, নখ বা শরীরের লোম না কাটা সুন্নাত।
-
পশুর যত্ন:
- পশুকে পর্যাপ্ত খাবার ও পানি দেওয়া, নম্রভাবে আচরণ করা এবং অযথা কষ্ট না দেওয়া।
- পশুকে জবাইয়ের স্থানে নিয়ে যাওয়ার সময় নির্দয় আচরণ এড়ানো।
-
তাকবিরে তাশরিক:
- জিলহজের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রতি ফরজ নামাজের পর তাকবিরে তাশরিক পড়া:
"আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।"
- জিলহজের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রতি ফরজ নামাজের পর তাকবিরে তাশরিক পড়া:
কোরবানির জবাইয়ের নিয়ম
জবাইয়ের সময় শরিয়তের নিম্নলিখিত নিয়ম মেনে চলতে হবে:
-
জবাইকারী:
- জবাইকারী মুসলিম হতে হবে। নিজে জবাই করা উত্তম, তবে অন্য মুসলিমকে দায়িত্ব দেওয়া যায়।
- জবাইয়ের সময় নিয়ত করা এবং পশুর মুখ কিবলার দিকে রাখা।
-
দোয়া পড়া:
- জবাইয়ের আগে নিম্নলিখিত দোয়া পড়া:
"ইন্নি ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিয়া লিল্লাজি ফাতারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা হানিফাও ওয়া মা আনা মিনাল মুশরিকিন। ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।"
- তারপর বলা: "আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়া লাকা, আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল মিন্নি।" (অর্থ: হে আল্লাহ, এটি তোমার পক্ষ থেকে এবং তোমার জন্য। হে আল্লাহ, আমার পক্ষ থেকে এটি কবুল করো।)
- বিসমিল্লাহ বলে "আল্লাহু আকবার" উচ্চারণ করে জবাই করা।
- জবাইয়ের আগে নিম্নলিখিত দোয়া পড়া:
-
জবাইয়ের পদ্ধতি:
- ধারালো ছুরি ব্যবহার করা, যাতে পশু কম কষ্ট পায়।
- গলার প্রধান শিরা (শ্বাসনালী, খাদ্যনালী এবং দুটি প্রধান রক্তনালী) কাটতে হবে।
- পশু সম্পূর্ণ মৃত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা এবং তাড়াহুড়ো না করা।
-
অন্যান্য:
- এক পশুকে জবাই করার সময় অন্য পশুকে সামনে না আনা, যাতে তারা ভয় না পায়।
- জবাইয়ের সময় নির্দয় আচরণ বা অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা এড়ানো।
গোশত বণ্টনের নিয়ম
- ভাগ: গোশত তিন ভাগে ভাগ করা মুস্তাহাব:
- এক ভাগ নিজ পরিবারের জন্য।
- এক ভাগ আত্মীয়, প্রতিবেশী বা বন্ধুদের জন্য।
- এক ভাগ দরিদ্র ও অভাবীদের জন্য।
- দান: গোশত দান করার সময় দরিদ্রদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। অমুসলিম দরিদ্রদেরও দান করা যায়।
- বিক্রি নিষিদ্ধ: গোশত বিক্রি করা বা কসাইয়ের মজুরি হিসেবে দেওয়া নিষিদ্ধ।
কোরবানির চামড়া ও অন্যান্য অংশ
- চামড়া: চামড়া দান করা উচিত। এটি বিক্রি করা বা কসাইকে দেওয়া নিষিদ্ধ। তবে বিক্রির অর্থ দান করা যায়।
- অন্যান্য অংশ: পশুর হাড়, শিং বা অন্যান্য অংশ ব্যবহার বা দান করা যায়, তবে কুসংস্কারের জন্য (যেমন, শিং ঝুলানো) ব্যবহার নিষিদ্ধ।
কোরবানির সতর্কতা
- ভুল নিয়ত: কোরবানি শুধু আল্লাহর জন্য হতে হবে। প্রদর্শন বা সমাজের চাপে কোরবানি করা গ্রহণযোগ্য নয়।
- অযোগ্য পশু: ত্রুটিযুক্ত পশু নির্বাচন করলে কোরবানি পূর্ণ হবে না।
- অপচয়: ঋণ করে বা সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে কোরবানি করা উচিত নয়।
- কুসংস্কার: গোশত বা রক্ত দিয়ে রোগ সারানোর ধারণা ভ্রান্ত ও শিরকের শামিল হতে পারে।
কোরবানির উপকারিতা
- আধ্যাত্মিক: কোরবানি আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম এবং ত্যাগের চেতনাকে জাগ্রত করে।
- সামাজিক: গোশত বিতরণ সমাজে দরিদ্রদের সাহায্য করে এবং ঐক্য বৃদ্ধি করে।
- অর্থনৈতিক: কোরবানি অর্থনীতিতে পশু ব্যবসা ও সংশ্লিষ্ট খাতকে চাঙ্গা করে।
উপসংহার
কোরবানি একটি পবিত্র ইবাদত, যা শরিয়তের নিয়ম-কানুন মেনে সম্পন্ন করলে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সমাজে কল্যাণ বয়ে আনে। সঠিক পশু নির্বাচন, জবাইয়ের পদ্ধতি, গোশত বণ্টন এবং শরিয়তের বিধান মেনে কোরবানি করা অত্যন্ত জরুরি। এই ইবাদতের মাধ্যমে মুসলিমরা হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর ত্যাগের চেতনাকে ধারণ করে এবং সমাজে ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখে। তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত কোরবানির নিয়ম-কানুন সম্পর্কে জানা এবং তা যথাযথভাবে পালন করা।